‘মরা ছেলেটাকে ব্যাগে ভরে কান্না ভুলে গেলাম’

ভারতের পশ্চিমবঙ্গে কালিয়াগঞ্জের মুস্তাফানগরের ডাঙিপাড়ার অসীম দেবশর্মা নামে এক দিনমজুর কাজ করেন কেরালায়।

স্ত্রী সাগরীর যমজ সন্তান হয় ৫ মাস আগে। দুই ছেলের অসুস্থতার খবর পেয়ে দিন কয়েক আগে বাড়ি ফিরেন তিনি।

অসীমের এক ছেলে দুদিন আগে সুস্থ হয়ে গিয়েছিল। বৃহস্পতিবারই তাকে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। আরেক ছেলে উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি ছিল। তার মৃত্যু হয় শনিবার রাতে।

রাত সাড়ে ৯টার দিকে ছেলে মারা যায়। হাসপাতালে তখন স্বাভাবিকভাবেই ভেঙে পড়েন তিনি। তখনো বুঝেননি কী দুঃসময়ের মধ্য দিয়ে যেতে হবে! ভেবেছিলেন, হাসপাতালই হয়তো সকালে অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করে দেবে। কারণ বৃহস্পতিবার আরেক ছেলেকে অ্যাম্বুলেন্সে করেই বাড়ি নিয়ে গিয়েছিল সাগরী। বিনাপয়সায়।

সেই চিন্তা করে তিনি ১০২ নম্বরে ফোন করেন। কিন্তু ওখান থেকে পরিষ্কার জানিয়ে দেওয়া হয়, মরদেহ নিয়ে তারা যাবেন না। নিয়ে যেতে হলে ৮ হাজার টাকা লাগবে! তখন অসহায় ওই বাবার কাছে সত্যিই টাকা ছিল না। ১৫-১৬ হাজার টাকা খরচ হয়ে গিয়েছিল। হাজার দু’য়েক টাকা মতো পড়ে ছিল পকেটে। তাদের ১৫০০ টাকার পৌঁছে দেওয়ার অনুরোধ করেন অসীম দেবশর্মা। তারা পরিষ্কার বলে দিল, ‘না, হবে না।’
অসীম দেবশর্মা বলেন, তখন সত্যিই ঘাবড়ে গিয়েছিলাম আমি। অত দূর কীভাবে নিয়ে যাব ছেলেকে! টাকাও তো নেই। তখন ভাবতে ভাবতে ছেলের মরদেহ ব্যাগের ভেতর ভরে নিয়ে যাওয়ার ভাবনাটা মাথায় আসে। সকালে আমার সঙ্গে একজন ছিলেন হাসপাতালে। তিনি ২২০ টাকা দিয়ে একটা ব্যাগ কিনে এনে দেন।

ছেলের লাশ যখন ওই ব্যাগে ভরছিলাম, আমার গা-হাত-পা কাঁপছিল রীতিমতো! সঙ্গে কিছু কাপড়-চোপড় ছিল। ওগুলো দিয়েই মুড়িয়ে ঢেকে রেখেছিলাম ছেলের দেহ। ওই কষ্টটা আমার পক্ষে বলে বোঝানো সম্ভব নয়।

তবে ভীষণ ভয় করছিল। ব্যাগে একটা বাচ্চা ছেলের দেহ নিয়ে এতটা রাস্তা যাওয়া! কোনোভাবে যদি রাস্তায় ধরা পড়ে যাই, এই ভয়টা পাচ্ছিলাম। ওখান থেকে প্রথমে রায়গঞ্জের বাসে উঠি। ব্যাগটা আমার কাছে বাঙ্কারে রেখেছিলাম। বাসে এক মুহূর্ত স্থির হয়ে বসে থাকতে পারছিলাম না আমি।

খালি মনে হচ্ছিল, এই বুঝি কেউ এসে আমার ব্যাগটা খুলে দেখবে। কাঁদব কী, ভয়ে দরদর করে ঘামছিলাম! তখন আমার মাথায় শুধু ঘুরছিল যে, আমাকে আবার বাস পাল্টাতে হবে। আবার একটা অন্য বাসে উঠতে হবে।

রায়গঞ্জে নামলাম। বাসের লোকটাই বলে দিয়েছিল, অন্য বাসটা কোথা থেকে ধরতে হবে। রায়গঞ্জে নেমেই বাড়িতে ফোন করি। সবটা জানাই। তার পর বাস ধরে কালিয়াগঞ্জে পৌঁছাই। বাসস্ট্যান্ডে নেমে দেখি প্রচুর লোকজন। মিডিয়াও এসেছে। অ্যাম্বুলেন্সও ছিল।

স্থানীয় কাউন্সিলর গৌরাঙ্গ দাস খবর পেয়ে একটা অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। কালিয়াগঞ্জে বিবেকানন্দ মোড় থেকে আমার গ্রাম ৮ কিলোমিটার দূরে। অ্যাম্বুলেন্সে করেই ওই রাস্তাটা ফিরেছিলাম। ছেলের শেষকৃত্য করেছি।

আমি গরিব মানুষ। কোনো উপায় না দেখে এই কাজ করতে বাধ্য হয়েছি। বাবা হয়ে ছেলের মরদেহ ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে বাড়ি ফিরতে হয়েছে! এ দুঃখটা চিরদিন আমার মনে চাপা পড়ে থাকবে।

awesome)

About admin

Check Also

চট্টগ্রাম থেকে অপহৃত যুবক মিয়ানমারে উদ্ধার

চট্টগ্রাম থেকে অপহরণ হওয়া এক যুবককে ১৫ দিন পর মিয়ানমার থেকে উদ্ধার করেছে পুলিশ। তার …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *