আবহাওয়ার পূর্বাভাস কীভাবে দেওয়া হয়, কতটা নির্ভরযোগ্য

ভৌগোলিক অবস্থান, পূর্ব আবহাওয়ার ইতিহাস, তাপমাত্রা, বায়ুচাপ, বায়ুর আর্দ্রতা, জলবায়ু, প্রাকৃতিক পরিবেশ, বনাঞ্চলের পরিমাণ ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ ও প্রাপ্ত উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বিদ্যমান আবহাওয়া ও অদূর ভবিষ্যতের আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেওয়া হয়ে থাকে। বর্তমানে উন্নত বিশ্বে স্যাটেলাইটসহ বিভিন্ন উৎস থেকে তাপমাত্রা, চাপ, আর্দ্রতা এবং বাতাসের গতির মতো পর্যবেক্ষণগুলো সারা বিশ্ব থেকে সংগ্রহ করা হয়। এরপর সেই বিপুল পরিমাণ ডেটা শক্তিশালী সুপার কম্পিউটারে প্রক্রিয়া করা হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যুক্তরাজ্যের আবহাওয়া অফিস ১২০ কোটি পাউন্ড মূল্যের সুপার কম্পিউটার ব্যবহার করে। এই ক্ষেত্রে প্রধান ফ্যাক্টর হলো, এই কম্পিউটারগুলো একটি পূর্বাভাস তৈরি করতে এসব উপাত্ত কত দ্রুত প্রক্রিয়া করতে পারছে। পরিমাপের সাধারণ পদ্ধতিআবহাওয়ার পূর্বাভাস দেওয়ার একটি সাধারণ কৌশল হলো হলো বায়ুর আর্দ্রতা পরিমাপ করা। সিক্ত ও শুষ্ক বাল্ব আর্দ্রতামাপক যন্ত্র (হাইগ্রোমিটার) ব্যবহার করে এটি করা হয়। এটি হলো দুটি থার্মোমিটার সমন্বিত একটি ডিভাইস, যা একটি শুকনো বাল্ব এবং একটি ভেজা বাল্বের সমন্বয়ে তৈরি। এটি বায়ু বা অন্যান্য গ্যাসের আর্দ্রতা বা আপেক্ষিক আর্দ্রতা নির্ধারণে ব্যবহৃত হয়। এই যন্ত্রের সাহায্যে আবহাওয়ার একটা মোটামুটি পূর্বাভাস দেওয়া যায়। সিক্ত ও শুষ্ক বাল্ব হাইগ্রোমিটার যন্ত্রে দুটি থার্মোমিটার পাশাপাশি ঝোলানো থাকে। এর মধ্যে একটি থার্মোমিটারের বাল্ব শুকনো থাকে; এই থার্মোমিটার থেকে বায়ুর তাপমাত্রা মাপা হয়। অন্য থার্মোমিটারটির নিচের অংশে একটি লম্বা কাপড়ের টুকরোর অগ্রভাগ প্যাঁচানো থাকে; কাপড়ের টুকরোর অন্য প্রান্তটি একটি পাত্রে পরিষ্কার পানিতে ডোবানো থাকে। পানির কারণে কাপড়ের টুকরোটি সব সময় ভেজা থাকে, তাই দ্বিতীয় থার্মোমিটারের বাল্বটিও ভেজা থাকে। কাপড়টি থেকে সব সময় পানি বাষ্প হয়ে উড়ে যেতে থাকে। বাষ্পীভবন প্রক্রিয়ায় নিয়মিত তাপ হারাতে থাকে, তাই ভেজা বাল্ব থার্মোমিটারটি সব সময় শুষ্ক বাল্ব থার্মোমিটার থেকে কম তাপমাত্রা দেখায়। তাপমাত্রাটি কতটা কম হবে, সেটি নির্ভর করে বাতাসের আর্দ্রতার ওপর।দুই থার্মোমিটারের পাঠের পার্থক্য পর্যবেক্ষণ করে বায়ু কতটা শুষ্ক বা আর্দ্র, তা জানা যায়। এ থেকে আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেওয়া যায়। এই কৌশলের ক্ষেত্রে রুল অব থাম্ব হলো: থার্মোমিটারের পাঠের পার্থক্য বেশি হলে আবহাওয়া শুষ্ক থাকবে; কম হলে আবহাওয়া আর্দ্র থাকবে; পার্থক্য ধীরে ধীরে কমতে থাকলে বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে; হঠাৎ কমে গেলে ঝড় হতে পারে। আবহাওয়া পরিমাপে যন্ত্র ও কৌশল উদ্ভাবন ১৬৪৩ সালে ইতালির পদার্থবিজ্ঞানী এভানজেলিস্টা টরিসিলি বায়ুর চাপ মাপার যন্ত্র ব্যারোমিটার উদ্ভাবন করেন। আবহাওয়ার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বায়ুর চাপ ওঠানামা করে। চাপ হঠাৎ কমে যাওয়া ঝড়ের সংকেত দেয়। বায়ুমণ্ডলের আর্দ্রতা পরিমাপের যন্ত্র হাইগ্রোমিটার। এটি ১৬৬৪ সালে উদ্ভাবিত হয়। আর ১৭১৪ সালে জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী ডেনিয়েল ফারেনহাইট পারদ থার্মোমিটার উদ্ভাবন করেন। এরপর থেকে তাপমাত্রা সঠিকভাবে পরিমাপ করা সম্ভব হয়।  ১৭৬৫ সালে দিকে ফরাসি বিজ্ঞানী আঁতোয়াঁ লোরাঁ ল্যাভয়সিয়ের প্রস্তাব করেন, প্রতিদিনের বায়ুর চাপ, আর্দ্রতা এবং বাতাসে গতি ও দিক পরিমাপের তথ্য–উপাত্ত জানা থাকলে এক বা দুদিন আগে আবহাওয়া সম্বন্ধে প্রায় সঠিক পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব। এরপর এসব প্রাকৃতিক নিয়ামকের উপাত্ত সংগ্রহে আধুনিক অনেক যন্ত্রপাতি উদ্ভাবিত হয়েছে। বর্তমানে সারা পৃথিবীতে অনেক আবহাওয়া কেন্দ্র আছে, যেখান থেকে রেডিয়োসন্ড যুক্ত বেলুন উড়িয়ে দেওয়া হয়। রেডিয়োসন্ড যন্ত্র দিয়ে বায়ুর চাপ, তাপমাত্রা এবং আপেক্ষিক তাপমাত্রা পরিমাপ করা যায়। ওই তথ্য পরে রেডিওর মাধ্যমে আবহাওয়া কেন্দ্রে পাঠানো হয়। এ ছাড়া এসব তথ্য সংগ্রহে রাডারও ব্যবহার করা হয়। রাডারের বেতার তরঙ্গগুলো মেঘে বৃষ্টিকণা ও বরফকণায় আঘাত পেয়ে ফিরে আসে। আবহাওয়াবিদেরা তখন বুঝতে পারেন ঝড় কোন দিকে চালিত হচ্ছে। ১৯৬০ সালে বিশ্বের প্রথম কৃত্রিম আবহাওয়া উপগ্রহ টিরোস-১ টিভি ক্যামেরাসহ উৎক্ষেপণ করা হয়। এটি ছিল আবহাওয়া পর্যবেক্ষণে অনেক বড় অগ্রগতির সূচনা। এখন আবহাওয়ার কৃত্রিম উপগ্রহগুলো এক মেরু থেকে অন্য মেরু পর্যন্ত পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে। অন্যদিকে ভূ–স্থির কৃত্রিম উপগ্রহগুলো পৃথিবীর উপরিভাগে একটা নির্দিষ্ট অবস্থানে থাকে ও পৃথিবীর যে অংশটুকু এদের সীমার মধ্যে আছে সেখানকার তথ্য–উপাত্ত পাঠায়। নিয়মিত সংগৃহীত উপাত্তগুলো প্রক্রিয়া করে পূর্বাভাস তৈরির জন্য জটিল গাণিতিক সমীকরণ ব্যবহার করা হয়। অবশ্য কম্পিউটার আসায় বড় ও জটিল হিসাবগুলো তাড়াতাড়ি করা সম্ভব হচ্ছে। ব্রিটিশ গণিতবিদ লুইস ফ্রাই রিচার্ডসন প্রথম আবহাওয়ার পূর্বাভাস দিতে আধুনিক গাণিতিক কৌশলের অবতারণা করেন। তবে বর্তমানে কখনো কখনো নির্দিষ্ট এলাকার পূর্বাভাস দেওয়ার জন্য আলাদা গাণিতিক মডেল ব্যবহার করা হয়ে থাকে।বাংলাদেশে কীভাবে আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেওয়া হয়বাংলাদেশের আবহাওয়াবিদেরা অ্যানালগ ও ডিজিটাল—দুই পদ্ধতিতেই কাজ করেন। সম্প্রতি অবশ্য নতুন একটি প্রযুক্তি যোগ হয়েছে। এখন ইন্টিগ্রেটেড হাই পারফরম্যান্স কম্পিউটিং সিস্টেমে আগামী অন্তত ১০ দিনের আবহাওয়ার পূর্বাভাস দিতে পারে বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তর। সারা দেশে ৪৭টি আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে। সেখান থেকে প্রতি তিন ঘণ্টা পরপর বাতাসের বেগ, তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়, মেঘের গতি ও তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় রাত–দিন। সেই তথ্যগুলো বিশ্লেষণ করে পূর্বাভাস প্রস্তুত করা হয়। এই তথ্য–উপাত্ত বিশ্লেষণের জন্য ২০১৮ সালে উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন কম্পিউটার সংযোজন করা হয়েছে। এই পদ্ধতিকে বলে অপারেশনাল নিওমেরিকেল ওয়েদার প্রেডিকশন। এই পূর্বাভাসে আবার স্যাটেলাইটের পর্যবেক্ষণগুলোও সংযোজিত থাকতে পারে। যেমন, ইউরোপিয়ান মেটিওরোলজিক্যাল স্যাটেলাইট পর্যবেক্ষণও প্রয়োজনে এই কম্পিউটার ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রসেস করা হয়। অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড়ের মতো দুর্যোগকালে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর পূর্বাভাস দিতে প্রয়োজনে ত্রি-মাত্রিক সমন্বয় করে। যেমন, ২০১৯ সালে ঘূর্ণিঝড় ফণীর পূর্বাভাসে যেসব উপাত্ত ব্যবহার করেছিল সেগুলো হলো: •স্যাটেলাইট পর্যবেক্ষণ (ইউরোপিয়ান মেটিওরোলজিক্যাল স্যাটেলাইট পর্যবেক্ষণ বিশ্লেষণ) •রাডারের পর্যবেক্ষণ বিশ্লেষণ•আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণপ্রতি ছয় ঘণ্টা পরপর এই উপাত্ত হালনাগাদ করে পূর্বাভাস প্রচার করেছে আবহাওয়া দপ্তর। এ ছাড়া জাপান আবহাওয়া অধিদপ্তরের স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ঘূর্ণিঝড়ের তথ্য পেয়ে থাকে বাংলাদেশের আবহাওয়া বিভাগ। ইউরোপীয় আবহাওয়া বিভাগ থেকেও তথ্য নেওয়া হয়। আবহাওয়ার পূর্বাভাস কতটা নির্ভরযোগ্যআবহাওয়াবিদেরা পূর্বাভাস তৈরির জন্য এখন উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিভিন্ন উৎস থেকে উপাত্ত সংগ্রহ করেন এবং উন্নত কম্পিউটারে সেসব উপাত্ত প্রক্রিয়া করেন। অধিকতর সঠিকভাবে পূর্বাভাস দেওয়ার লক্ষ্যে অনেকগুলো গাণিতিক মডেলও উদ্ভাবিত হয়েছে। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, আবহাওয়ার পূর্বাভাসে যা বলা হয় তা শতভাগ সঠিক। এ কারণেই নিয়মিত পূর্বাভাসগুলোতে (আবহাওয়া বুলেটিন) ‘হতে পারে’ বলা হয়। আবহাওয়াবিদেরা পূর্বাভাস দেওয়ার সময় বলেন ‘হওয়ার সম্ভাবনা আছে’। বায়ুমণ্ডলের বিশৃঙ্খল প্রকৃতির কারণে সমুদ্রে নগণ্য পরিমাণ পরিবর্তনও যখন স্থলভাগে পৌঁছায় তখন আবহাওয়া পরিমাপক ব্যবস্থার ওপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল একটি বিশাল এবং জটিল ব্যবস্থা। এর প্রতিটি অংশ নির্ভুলভাবে পর্যবেক্ষণ করা অসম্ভব। ফলে অনিবার্যভাবে পর্যবেক্ষণগুলোতে ফাঁক থেকে যায়। ফলস্বরূপ, সামান্য পরিবর্তনের তথ্য বা উপাত্ত অগ্রাহ্য করা মানেই সামগ্রিকভাবে বৃহৎ ফলাফলে বড় পরিবর্তন ঘটে। এ কারণেই এখন থেকে সাত দিনের জন্য একটি পূর্বাভাস, সেই দিনটি আসার আগেই হয়তো বদলে যেতে পারে। আবহাওয়া অফিস আজ থেকে তিন দিন পর বৃষ্টির পূর্বাভাস দিলে, চতুর্থ দিনে খাঁ খাঁ রোদ দেখা যেতেই পারে! তবে যাইহোক, কম্পিউটার প্রযুক্তির অগ্রগতির পাশাপাশি বায়ুমণ্ডল সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের জানা–বোঝার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে আবহাওয়ার পূর্বাভাস আরও নির্ভুল হয়ে উঠছে। যেমন, ব্রিটেনের আবহাওয়া বিভাগ দাবি করে, ৩০ বছর আগে একদিনের পূর্বাভাস যতটা সঠিক হতো, এখন তারা চার দিনের পূর্বাভাস ততটাই সঠিক দিতে সক্ষম। তবে দীর্ঘতর পূর্বাভাসের ক্ষেত্রে এখনো অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এরপরও জলবায়ুর খুব বেশি পরিবর্তন না হলে এবং পূর্বের দীর্ঘ দিনের উপাত্ত হাতে থাকলে কম্পিউটার মডেল ব্যবহার করে আগামী কয়েক দশক পরের জলবায়ু সম্পর্কেও ধারণা দেওয়া সম্ভব।তথ্যসূত্র: বিবিসি, উইকিপিডিয়া, বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর Great)

About admin

Check Also

আটকে গেছে বিদেশি এয়ারলাইনসগুলোর ২১ কোটি ৪১ লাখ ডলার

বাংলাদেশে কার্যক্রম পরিচালনা করা বিদেশি এয়ারলাইনসগুলোর ২১ কোটি ৪১ লাখ ডলার অর্থ আটকা পড়েছে। বাংলাদেশি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *