তাজিংডংয়ের চূড়ায়

বান্দরবান থেকে দিনের শেষ বাস ধরে রওনা হলাম থানচির পথে। রাতের হিসাবে পূর্ণিমা ছিল বলে পথ আর পাহাড়ের সৌন্দর্যের কথা ভাবতে ভাবতে পাহাড়ের বুক চিড়ে চলেছে থানচির মিনিবাসটি। সেখানে এর আগেও গিয়েছিলাম, কিন্তু রাতে ভ্রমণ এই প্রথম। শীতের দিনের শেষ ভাগ। দিনের শেষ হওয়ায় পাহাড়ের কোলজুড়ে কুয়াশার চাদর বিছানো। দেখতে দেখতে পেরিয়ে যাচ্ছি একের পর এক দারুণ উঁচু পাহাড়।বিস্তৃত অরণ্যভূমিতে জেগে থাকা হাজারো অচেনা পথ পেরিয়ে থানচি বাজারে পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত ৮টার মতো বেজে গেল। আগে থেকে থানচির সাঙ্গু নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন রেমাক্রির সরকারি স্কুলের শিক্ষক জয় মারমা। রাতে থাকার ব্যবস্থা তাঁদের বাসায়। থানচির সাঙ্গু নদীর পাড়ে এমন একটা পাহাড়ি ঘরে থাকার ইচ্ছাটা এবার পূরণ হলো। সাঙ্গু নদীর তাজা কাতল মাছ দিয়ে রাতের ভোজনপর্বটা সেরে নিলাম বাজারের পাহাড়িকা হোটেলে।ভোরের থানচি। চারপাশে কুয়াশা। দীর্ঘ পথ ট্রেক করতে হবে, তাই ভোরেই রওনা দিলাম। এবারের গন্তব্য দেশের অন্যতম শীর্ষ পাহাড়চূড়া তাজিংডং। এটি সরকার স্বীকৃত বাংলাদেশের সবচেয়ে উঁচু পাহাড়চূড়া। ভোরের আলোয় রওনা হলাম পাহাড়ি পথ ধরে। শীতের দিনের পাহাড় সবুজ রং হারাল, কুয়াশায় মোড়ানো পথ বেশ উপভোগ্য। উঁচু-নিচু পাহাড়ি পথ, পথে পথে ছোট জুম ঘর। পাহাড়ের চূড়া বেয়ে নামছে সকালের নির্মল সোনালি সূর্যের প্রথম রশ্মি। উঁচু পাহাড় থেকে নিচে পড়া সূর্যের কিরণ!পথ চলতে চলতে পাহাড়ের ওপর থেকে চোখে পড়ে বোডিং পাড়া। থানচি থেকে রওনা হয়ে প্রথম পাড়ার দেখা পেলাম। পাহাড়ের বুকে গড়ে উঠেছে ঝিরি পাড়ের এই পাড়া। ম্রো আদিবাসীদের বসবাস এখানে। ঝিরির ঠান্ডা জলের পরশ নিয়ে কিছুক্ষণ পরেই যাত্রা করলাম তাজিংডংয়ের পথে। বোডিং পাড়ার দীর্ঘ খাড়া পাহাড় পেরিয়ে যেতে হবে। এই পাহাড়ের উচ্চতা দেখেই চোখ কপালে উঠল। ক্রমাগত উত্তপ্ত হয়ে ওঠা দিনের সূর্য হাঁটার গতি কমিয়ে দিচ্ছে ক্রমাগত। ভোরের কুয়াশা, সকালের কিরণ, ভরদুপুরের প্রচণ্ড গরম—এসব নিয়েই চলেছি উঁচ-নিচু পাহাড়ের সরু পথ বেয়ে। জুমখেতের পথ পেরিয়ে কখনো ঝিরি, কখনো ঝরনা বেয়ে আসা ঠান্ডা জলের স্রোত, বুনো ট্রেইল—এসব পায়ে ঠেলে চলেছি তাজিংডংয়ের পথে। দুপুরের শেষ দিকে পৌঁছে যাই শেরকর পাড়ায়। বলা যায় এটি তাজিংডংয়ের বেসক্যাম্প। পাহাড়ঘেরা এই জনপদে প্রথম এলাম। এ পাড়ায় বম জনগোষ্ঠীর বসবাস। পাড়ায় ঢুকতেই কথা হয় কার্বারির সঙ্গে। ভরদুপুরে কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে আবার রওনা হলাম। শেরকর পাড়া থেকে তাজিংডং দুই ঘণ্টার পথ। কিন্তু পুরোটা পথ উঠতে হবে মানে আপ হিল। দুপুরের শেষ দিকে পা বাড়ালাম তাজিংডংয়ের পথে। বুনো পথে ছড়ানো সৌন্দর্যের মালা। কোথাও কোথাও বুনো ফুলের দল, চেনা-অচেনা কীটপতঙ্গ, কান ভারী করা পাহাড়ি পোকার তীব্র শব্দ। এসব দেখতেই দেখতেই পা ফেলছি একের পর এক। কিন্তু এমন কষ্টকর পথের যেন শেষ নেই! তীব্র গরমে গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল প্রায়শ। পুরোটা পথে আমাদের চেনা সভ্যতার কোনো চিহ্নমাত্র নেই।পথ চলতে চলতে একসময় কিছুটা দূর থেকে চোখে পড়ে প্রায় এক সারিতে দাঁড়িয়ে আছে তিনটি চূড়া। সর্বোচ্চটা দেখে বোঝা যাচ্ছিল। নর্থ চূড়া বলেই ট্রেকারদের কাছে পরিচিত। এটি তাজিংডংয়ের সেন্ট্রাল চূড়া থেকেও উঁচু। ক্লান্ত শরীর ভেঙে উঠছি নর্থ পিকের চূড়ায়। চূড়ায় উঠে দীর্ঘশ্বাসটা যেন একটা সার্থকতা খুঁজে পায়।সর্বোচ্চ চূড়া থেকে নিচের পাহাড়ি খাঁজ, জুমখেত, চোখের সীমানায় বন্দী হওয়া পাহাড়ি পাড়া—সবকিছু তুচ্ছ মনে হয়। চূড়ায় দাঁড়িয়ে কেবল মনে হচ্ছিল, ‘পাহাড়কে কখনো জয় করা যায় না, শ্রদ্ধায় অবনত হতে হয়।’ তাজিংডংয়ের চূড়া দূর আকাশের গায়ে হেলান দেওয়া পাহাড় আর মেঘমল্লার দল দেখে মনে হচ্ছে, এই বিস্তৃত অরণ্যভূমি পেরোলেই যেন ধরা দেবে নতুন কোনো স্বপ্ন। awesome)

About admin

Check Also

চেনা চরিত্রে হলিউডে সামান্থা

‘দ্য ফ্যামিলি ম্যান’ সিরিজে অভিনয় করে ভারতজুড়ে জনপ্রিয়তা পান দক্ষিণের নায়িকা সামান্থা রুথ প্রভু। সম্প্রতি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *