দক্ষিণ এশিয়ায় দেশ গঠনচেষ্টা কতটা ব্যর্থ হয়েছে, তার সর্বশেষ নজির মণিপুরের ঘটনা। মণিপুর একটা ছোট রাজ্য। দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সব দেশের মতো বহু জাতির রাজ্য এটা। অথচ সেখানে হঠাৎ জাতিগত সংঘাতে ৫০-৬০ জন মানুষ মারা গেল। সবাই কেবল আগুনের ছবি, আগুনে পোড়া চার্চের ছবি এবং মৃতদের সংখ্যা জানাচ্ছে। মৃত্যু এখানে কেবল সংখ্যা। কিন্তু মণিপুরের ঘটনা হতাহতের বাইরেও বহু বার্তা দিচ্ছে—কেবল ভারত ইউনিয়নবাসীদের নয়, আশপাশের সব দেশকে। দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সবাইকে। দাঙ্গার পেছনে জাতিগত টেনশননিকট অতীতে আন্তর্জাতিক মানবাধিকারকর্মীদের কাছে মণিপুরের বিশেষ পরিচিতি ছিল ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে’র জন্য। সেসব ঘটনার পেছনে ছিল বিচ্ছিন্নতাবাদ এবং তা দমনের চেষ্টা। রাজ্যজুড়ে তার রেশ এখনো মৃদুলয়ে বহমান।এই রাজ্যে মণিপুরিরা সংখ্যায় বড় জাতি—পুরো লোকসংখ্যার অর্ধেকের মতো। এরা বেশি থাকে রাজধানী ইম্পলসহ সমতলে। এরা মেইতেই নামেও পরিচিত। রাজ্যের পাহাড়ি এলাকায় থাকে অন্য অনেকগুলো ট্রাইবাল জনগোষ্ঠী।যাদের এককাতারে ‘জো-জাতি’ বলা যায়। সাম্প্রতিক দাঙ্গায় মেইতেই ও জোদের মুখোমুখি দেখা গেল।এই দাঙ্গাকে কি ধর্মীয় সমীকরণে দেখা যায়? উত্তর হ্যাঁ এবং না উভয়ই। যদিও মণিপুরিদের বড় অংশ হিন্দু ধর্মাবলম্বী এবং অন্যান্য ছোট ছোট জাতি খ্রিষ্টান—কিন্তু এটাকে সরাসরি হিন্দু-খ্রিষ্টান দাঙ্গা বলা যায় না। দাঙ্গার প্রধান কারণ জাতিগত। তবে দাঙ্গা ঘটানো হয়েছে রাজনৈতিক আদলে এবং এর পেছনে ধর্মীয় গুরুদের ইন্ধন থাকার সন্দেহ আছে; বিশেষ করে মণিপুরিদের মাঝে আরএসএস এবং পাহাড়িদের মাঝে মিশনারিরা প্রভাব বাড়ানোর প্রচেষ্টায় আছে।চলতি দাঙ্গাকে চার্চ বনাম মন্দিরের সমীকরণে ফেলতে পারলে বিজেপির দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক লাভ আছে এখানে। আগামী বছর নির্বাচনের মৌসুম। ২০১৪ সালে কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার সময় মণিপুরে বিজেপি ছিল প্রভাবহীন এক দল। এক দশক না পেরোতেই তারা সেখানকার ক্ষমতায় আসা-যাওয়া নিয়ন্ত্রণ করছে।চলতি দাঙ্গায় তাদের কর্তৃত্ব আরেক ধাপ বাড়ল।ছোট এই রাজ্যে আরএসএসের ‘শাখা’, ‘মিলন’ ও ‘মণ্ডল’ মিলে ১১৫টি ইউনিট কাজ করছে। এখানে আরএসএসের কাজের একটা কৌতূহলোদ্দীপক দিক হলো, মেইতেইদের তারা মূলত ‘অবৈধ বাংলাদেশি’ ভীতি দিয়ে সংঘবদ্ধ করছে। অথচ রাজ্যে কাছাড়সংলগ্ন জিরিবাম জেলায় কেবল পুরোনো দিনের কিছু বাংলাভাষী আছে—যাঁরা সিলেটি উচ্চারণে বাংলা বলেন। সংখ্যায় বাংলাভাষীরা এই রাজ্যে দুই ভাগও নয়।ট্রাইবালদের মাঝে জমি হারানোর ভয়এটা অনেকের জানা, বাংলাদেশ-পাকিস্তান-ভারত-শ্রীলঙ্কা সব দেশে প্রান্তিক জাতিগুলোর ক্ষোভ-দুঃখ সব সময় আড়ালে রাখার স্থায়ী চেষ্টা করা হয়। ফলে যখন সেগুলোর বিস্ফোরণ ঘটে, তখন মনে করিয়ে দেওয়া হয় এটা হঠাৎ ঘটে যাওয়া একটা দুর্ঘটনা; ‘রাষ্ট্রে’র যেন কিছুই করার ছিল না!মণিপুরের এই দাঙ্গা কিন্তু হঠাৎ ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার মতো নয়। যাঁরা খোঁজখবর রাখেন তাঁরা জানেন, এটা ঘটতই। সেখানে অনেকগুলো ইস্যুতে জোদের সঙ্গে মণিপুরিদের ব্যবধান বাড়ছিল। এই ব্যবধান কমানোর জন্য যারা দায়িত্বরত, তারা চুপচাপ বসে ছিল। তাদের অন্য প্রকল্প থাকতে পারে।দাঙ্গার সর্বসাম্প্রাতিক কারণ ছিল কোর্ট কর্তৃক মেইতেইদের ‘শিডিউল ট্রাইব’ বানানোর উদ্যোগ গ্রহণ থেকে। ছোট ট্রাইবালগুলো এর বিরোধী। শেষোক্তরা মনে করে, এতে মণিপুরিরা বর্তমানে যে সুবিধাজনক অবস্থায় আছে, সেটা আরও বাড়িয়ে নেবে এবং শিডিউল ট্রাইব ছোটদের সুবিধাগুলোতে ভাগ বসাবে।শিডিউল ট্রাইব স্বীকৃতি পেলে নির্বাচন ও চাকরিতে সংরক্ষণ-সুবিধা বাড়ে। ভারতজুড়ে ছোট ছোট অনেক জাতির জনপ্রিয় দাবি এটা। মণিপুরে ট্রাইবালরা মনে করছিল, মণিপুরিরা শিডিউল ট্রাইব ঘোষণা পেতে কোর্টকে প্রভাবিত করছে। এই সন্দেহের পেছনে বড় কারণ বর্তমান বিজেপি সরকারের মুখ্যমন্ত্রী একজন মণিপুরি। প্রশাসনেও মণিপুরিদের প্রভাব আছে। মণিপুরে সব সরকারকে মণিপুরিরা প্রভাবিত করে। রাজ্যের ১০ ভাগের মতো এলাকায় থেকেও রাজনীতিতে প্রায় একচেটিয়া প্রভাব বিস্তারের জায়গায় আছে তারা। বিধানসভার ৬০ আসনের ৩৯টি মণিপুরিদের এলাকায়। এ পর্যন্ত ১৩ মুখ্যমন্ত্রীর ১১ জন মেইতেইদের ভ্যালি থেকে হয়েছেন। এতে ৯০ ভাগ পাহাড়ি এলাকার বাসিন্দা অ-মণিপুরিরা বহুকাল ধরে নীরবে ক্ষুব্ধ। মুখমন্ত্রী মণিপুরি ভোটারদের খুশি করছিলেন বলে ট্রাইবালরা ভেবেছে। মেইতেইরা শিডিউল ট্রাইব স্বীকৃতি পেলে পাহাড়ি এলাকায় জমি কিনতে পারবে—এত দিন যা পারত না—এ-ও পাহাড়িদের ভয়। তবে এর বাইরেও দাঙ্গার কারণ আছে।পারস্পরিক অবিশ্বাসে রক্ষণশীল মনোভাবের বিস্তারমণিপুরে অন্যান্য দেশের অনেক ‘জো-পিপল’ বিপদে পড়ে আশ্রয় নিয়ে আছে; বিশেষ করে মিয়ানমারের চিন প্রদেশ থেকে অনেকে পালিয়ে এসেছে এখানে।বাংলাদেশ থেকেও কিছু বম মিজোরামে গেছে বলে পত্রপত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে।ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এ রকম হুটহাট যাওয়া জোদের তাড়াতে চায়। দক্ষিণ এশিয়ার জোরা ভ্রাতৃপ্রতিম জনগোষ্ঠী। তারা ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া সীমান্তের বিভিন্ন প্রান্তে আটকা পড়ে থাকলেও একে অপরকে সাহায্য-সহযোগিতা করার পক্ষে। সে কারণে মণিপুর থেকে তথাকথিত অবৈধ জো—তথা কুকি-চিনদের তাড়ানোর বিপক্ষে তারা। স্থানীয় মণিপুরিরা আবার এর পক্ষে। তারা অন্য দেশ থেকে আসা জোদের ‘মাদক ব্যবসায়ী’ হিসেবে প্রচার করে এবং ভয় পায় যে এ রকম ট্রাইবালরা সংখ্যায় বাড়লে তারা সংখ্যালঘু হয়ে যেতে পারে। এ নিয়েও ঝামেলা চলছিল। অবৈধ জোদের উচ্ছেদ করতে গিয়ে অনেক জায়গায় চার্চ উচ্ছেদ করা হয়েছে। এ ধরনের ‘অভিযান’ চলছে ‘মাদকবিরোধী অভিযান’-এর নামে। এ-ও ট্রাইবালদের ক্ষুব্ধ করেছে। যে বনে তারা বহুকাল ছিল এবং আছে—এখন সে জায়গা ‘সংরক্ষিত বন’ বানিয়ে তাদের অবৈধ তকমা দিয়ে উচ্ছেদ করা হচ্ছে। এটা তারা কেন মানবে? এই অবস্থার একটা প্রতিক্রিয়াশীল প্রতিক্রিয়া হলো—আন্তজাতি সম্প্রীতির অভাবে প্রতিটি জাতি নিজেদের এলাকায় ‘ইনার লাইন প্রথা’ চায়। আসামে একসময় এটা ছিল—যার বিরুদ্ধে মওলানা ভাসানী আন্দোলন করেছিলেন।ইনার লাইন প্রথার দাবি হলো, এক গোষ্ঠীর জমিতে অন্যদের ঢুকতে বাধা দেওয়ার বিধান। দুনিয়ার অন্যদিকে সবাই যখন দরজা-জানালা সব খুলে দিচ্ছে, তখন দক্ষিণ এশিয়ায় জাতিগুলো চাইছে ইনার লাইন সিস্টেম। এর কারণ, এখানে ছোট-বড় সবাই জমি আর সংস্কৃতি হারানোর ভয়ে আছে। লুটেরা রাজত্ব সবাইকে হারানোর ভয়ে রাখছে। এই ভয়ের সমাধান হলো সাম্য-মৈত্রী ও স্বাধীনতার ভিত্তিতে জনশাসন। কিন্তু ধর্ম ও জাতিবাদী শাসক গুরুরা শেখাচ্ছেন ইনার লাইন প্রথার কথা; যা পরস্পরকে ঘৃণা করে দূরত্ব গড়তে শেখায়।মণিপুর দাঙ্গার প্রভাব পড়বে নাগাল্যান্ড ও মিজোরামেমণিপুরের দাঙ্গা তাৎক্ষণিকভাবে জানিয়ে দিচ্ছে বহু জাতি ও বহু ধর্মকে একত্র করা এবং একত্র রাখার জন্য প্রত্যেককে রাজনৈতিক নাগরিকতার ভিত্তিতে বিবেচনার ‘দেশ’ আজও গঠন হয়নি এ অঞ্চলে। রাজনীতিবিদেরা, ধর্মগুরুরা এখানে পরিচয়বাদী রাজনীতি করছেন এবং মাঝে মাঝে কোর্ট-কাচারিকেও সে কাজে নামাচ্ছেন। তাতে সমস্যা আরও জটিল হচ্ছে।মণিপুরের দাঙ্গার জাতিগত সমীকরণ সরাসরি প্রভাব ফেলবে নাগাল্যান্ড ও মিজোরামে। সম্ভবত আসন্ন দিনগুলোতে জো জাতির সঙ্গে অন্যদের সৃষ্ট এই দূরত্বের ছাপ পড়বে আশপাশের সব এলাকায়—সেই সব এলাকা যে দেশের অধীনেই থাকুক না কেন। নাগা ও কুকিরা এই দাঙ্গার বড় শিকার। যথাক্রমে নাগাল্যান্ড ও মিজোরামে তাদের ব্যাপারে সহানুভূতি রয়েছে। ফলে সেখানে মেইতেইদের বিরুদ্ধে পাল্টা প্রতিক্রিয়া হবে—এখন না হলেও ভবিষ্যতে। রাজ্যে কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ বাড়লমণিপুরে অনেকগুলো সশস্ত্র গ্রুপ আছে। মণিপুরিদের মাঝেও আছে। ট্রাইবালদের মাঝেও আছে। দাঙ্গায় মৃত্যুর সংখ্যা সে কারণেই দ্রুত বাড়ছে। দাঙ্গা থামাতে আগে থেকে রাষ্ট্র সক্রিয় না হলেও এখন সেখানে বিপুল সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। মনুষ্যবিহীন ড্রোন দিয়ে মণিপুরের আকাশে নতুন করে নজরদারির ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে। ব্যাপারগুলো বোধগম্য। মণিপুরে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ বিপুলভাবে বাড়ল। এতে লাভ কেন্দ্রের। প্রান্তকে ব্যবহার করেই কেন্দ্র এভাবে লাভবান হয়।পরিচয়বাদী রাজনীতিতে প্রতিটি সম্প্রদায় সব সময় আধিপত্য বা অধীনতার সমীকরণে চিন্তা করতে শেখে। তারা নাগরিক হিসেবে সামষ্টিক অধিকার চেতনা নিয়ে দাঁড়াতে পারে না। শাসকশ্রেণি এবং বিশেষভাবে আমলাতন্ত্র ঠিক এটাই চায়। পরিচয়বাদী বিভক্তি তাঁদের দরকার নিজস্ব সুবিধাজনক অবস্থা ধরে রাখতে। বাংলাদেশ-পাকিস্তান এ ফাঁদে আছে। ভারতের জনগণও আছে। শ্রীলঙ্কা ভয়ংকর এক গৃহযুদ্ধ শেষেও ওই ফাঁদ থেকে বের হতে পারছে না। বহুত্ববাদী মনন ও রাজনীতি ছাড়া যে দক্ষিণ এশিয়ার কোনো দেশের মুক্তি ও স্বস্তি নেই, মণিপুর আবার সেটাই জানাল।দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক awesome)
Check Also
আটকে গেছে বিদেশি এয়ারলাইনসগুলোর ২১ কোটি ৪১ লাখ ডলার
বাংলাদেশে কার্যক্রম পরিচালনা করা বিদেশি এয়ারলাইনসগুলোর ২১ কোটি ৪১ লাখ ডলার অর্থ আটকা পড়েছে। বাংলাদেশি …